সেলিম সানোয়ার পলাশ, রাজশাহী থেকেঃ স্বাভাবিক নিয়মেই প্রতি বছরের ন্যায় এবারও বরেন্দ্র অঞ্চলে ইরি-বোরো ধানে মাঠে ভরে গেছে। মাঠজুড়ে যে দিকে তাকাই শুধুই সোনালী শীর্ষের দোলা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। পাকতে শুরু করেছে মাঠ জুড়ে ধান। ফসল ঘরে তোলার অপেক্ষায় প্রহর গুনছেন বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষক ও শ্রমিকরা। তবে, করোনা ভাইরাসের কারণে অঘোষিত লকডাউন যত দীর্ঘ হচ্ছে ততই কৃষকদের কপালে পড়ছে চিন্তার ভাঁজ। পাশাপাশি বৈরী আবহাওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে । সব মিলিয়ে দুশ্চিনতায় কাটাচ্ছে বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষক ও শ্রমিকরা।
কৃষকেরা বলছেন, “প্রতি বছর দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ধান কাটার জন্য শ্রমিক আসে কিন্তু তারপরও তীব্র শ্রমিক সংকট দেখা দেয়। এ বছর করোনাভাইরাসের কারণে কোনো অঞ্চল থেকেই শ্রমিক আসতে চাচ্ছে না। আগামী ১০-১৫ দিনের মধ্যে জমির পাকা ধান কাটতে না পারলে সম্ভাব্য অতিবৃষ্টির কারনে বন্যা কবলিত মাঠে ফসলহানির আশঙ্কা রয়েছে। বৈশাখ মাসেই ঝড় বৃষ্টি শুরু হলে, জমিতে পানি জমা হবে, ধান ঝড়ে যাবে। এতে করে পাকা ধান আর কেটে ঘরে আনা যাবে না। ফলে ক্ষতির পরিমান বেড়ে যেতে পারে।
তবে, দুশ্চিন্তায় ঘুম নেই বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষকের। বর্তমানে করোনা ভাইরাসের জন্য অঘোষিত লকডাউন যত দীর্ঘায়িত হচ্ছে, ততই কৃষকদের দুশ্চিন্তা বাড়ছে। ধান কাটা ও ঘরে তোলার শ্রমিক কোথায় পাবেন? একদিকে নগদ টাকা হাতে না থাকা, অন্যদিকে করোনা পরিস্থিতি দ্রুত স্বাভাবিক না হওয়ার আশঙ্কা।
শ্রমীকরা বলছে, এ সময় আমরা গিরোস্তের জমির ধান কেটে জিন হিসাবে যে ধান পাই তা দিয়ে আমাদের প্রায় ৫ থেকে ৬ মাসের চালের চিন্তা করতে হয় না। বর্তমান করোনা ভাইরাস পরিস্থিতিতে কৃষক শ্রমিকসহ সবাই ঘরমুখো। বাড়ির বাইরে বের হওয়া যাচ্ছে না। আমরা কর্মহীন হয়ে পড়েছি। বাড়িতে নেই কোন খাবার। ধান কাটতে না পারলে সারা বছর না খেয়ে মরতে হবে।
গোদাগাড়ী কৃষি অফিস সুত্রে জানা যায়, চলতি বোরো মৌসুমে গোদাগাড়ী উপজেলায় ১৩ হাজার ৪’শ ৮৫ হেক্টর জমিতে ধানের চাষ করা হয়েছে।
তানোর উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, পুরো উপজেলায় চলতি বোরো মৌসুমে লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে ১৩ হাজার ১৫০ হেক্টর জমিতে ইরি-বোরো ধানের আবাদ করেছেন চাষিরা। এই দুই উপজেলায় সময় উপযোগী ও আগাম জাতের ধান পাঁকতে শুরু করেছে।
৬নং মাটিকাটা ইউনিয়নের পিরিজপুর গ্রামের কৃষক ফেন্সু বলেন, “অতীতের তুলনায় এ বছর ফসল ভালো হয়েছে। আমন আবাদে ধান পাকার পরেও ধান কাটতে হাতে কিছু সময় পাওয়া যায়। কিন্তু ইরি-বোরো মৌসুমে নানান রকম প্রাকৃতিক দূর্যোগ লেগেই থাকে। তাছাড়া শ্রমিকের সংকট, আবার এলাকার শ্রমিকও করোনা ভাইরাসের ভয়ে কাজ করতে চাচ্ছে না”। যদি উপজেলার কৃষি অফিস থেকে কৃষকদের ধান কাটার যন্ত্র দেন, তাহলে তারা নিজেরাই ধান কেটে ঘরে তুলতে পারবেন বলে আশাবাদ ব্যাক্ত করেন তিনি।
তানোর পৌর এলাকার জিওল-চাঁদপুর গ্রামের কৃষক চৈত্যা, আলতাব, রবিউলসহ আরও অনেকে জানান, কারোনা সংক্রমণ ঠেকাতে পারেনি তাদের বোরো আবাদকে। মাঠে ধান ক্ষেত দেখলে মন ভরে যাচ্ছে। আর মাত্র ৮-১০ দিনের মধ্যে বোরো ধান কাটা ও মাড়া পুরোদমে শুরু হবে। কিন্তু শ্রমিক সংকটের আশঙ্কায় তাদের ঘুম নেই। প্রতি বছর এ অঞ্চলের বোরো ধান বাইরের শ্রমিক ছাড়াও আশপাশের শ্রমিকরা কর্তন করতো। তবে, চলতি মৌসুমে বোরো ধান কর্তনের জন্য বাইরের শ্রমিক আসতে পারবে না বলে মোবাইলে জানাচ্ছে। আর আসবেই বা কি করে। বাস ও ট্রাকসহ সকল যানবাহন বন্ধ। শ্রমিক না আসলে ধান ঘরে তুলব কি করে? বর্তমানে ধান কাটার শ্রমিক পাওয়া নিয়ে দেখা দিয়েছে অনিশ্চয়তা। ফলে দুশ্চিন্তা কাটছে না তাদের।
দিনমজুর শ্রমিক লালু জানান, বর্তমান করোনা ভাইরাস পরিস্থিতিতে কৃষক শ্রমিকসহ সবাই ঘরমুখো। ফলে প্রায় ১ মাস ধরে কোন কাজ কর্ম নেই। চাল-ডাল ঘরে ফুরিয়ে আসছে। আশায় আছি মানুষের বোরো ধান কেটে সংসারে ভাতের জোগাড় হবে। কিন্তু করোনার ভয়ে ঘর থেকে বের হওয়া যাচ্ছে না। সরকারি বা বেসরকারি কোন প্রতিষ্ঠান কিংবা মেম্বার-চেয়রম্যানরা কোন সাহায্য সহায়তাও করছে না। এঅবস্থায় খোঁজও নিতে আসেনি কেউ। মনে হয় আর কিছুদিন পর তাদের পরিবারকে না খেয়ে মরতে হবে বলে আক্ষেপ করেন এই শ্রমিক।
গোদাগাড়ী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম জানান,এবার বোরো মৌসুমে গোদাগাড়ী উপজেলায় ধানের ভাল ফলন হবে বলে আশা করা হচ্ছে। তাছাড়া করোনা ভাইরাসের প্রভাবে লকডাউনজনিত কারনে যেন কৃষকদের ধান কাটা এবং মাড়াই কাজে যেন কোন প্রকার সমস্যা না হয় সে লক্ষ্যে উপজেলার সাবলম্বী কৃষকদের মাঝে ৭ টি কমবাইন্ড হারবেস্টর মেশিন দেওয়া হয়েছে। যে মেশিন ধান কাটা,মাড়াই,ধান ঝাড়াই এবং বস্তাবন্দী কাজে পারদর্শী। যা প্রতি ২০ মিনিটে ১ বিঘার ধান কাটা,মাড়াই,ঝাড়াই কাজে পূর্নতা এনে দিবে কৃষকদের মাঝে, সেক্ষেত্রে কৃষকদের এবার ধান ঘরে তোলাতে কোন প্রকার সমস্যা হবেনা বলে আশাবাদব্যাক্ত করেন উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা।
এদিকে তানোর উপজেলা কৃষি অফিসার শামিমুল ইসলাম বলেন, এবার এলাকার ও বাইরের শ্রমিক মাঠে ধান কাটতে ইউএনও স্যারকে অবগত করে হবে। এছাড়া সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে নিয়ম শৃংখলার মধ্যে কৃষককে ধান কাটতে হবে। তিনি আরও বলেন, কৃষকেরা সুষ্ঠু ভাবে ধান ঘরে তুুলতে পারলে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি ফলন হবে বলে আশা করছি। দেশের অবস্থা একটু স্বাভাবিক হলে শ্রমিক সংকট কেটে যাবে বলে জানান তিনি।